বর্তমান সময়কে কাজে লাগাও : জেসিকা লেঞ্জ

জেসিকা লেঞ্জ মার্কিন অভিনেত্রী। তাঁর ঝুলিতে আছে দুটি অস্কার, দুটি অ্যামি, পাঁচটি গোল্ডেন গ্লোবসহ অসংখ্য পুরস্কার। ২০০৮ সালের ২৩ মে নিউইয়র্কের সারা লরেন্স কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তৃতা দেন।

আজকের এই সুন্দর সকালে আমরা এখানে এসেছি তোমাদের সমাবর্তন উদ্যাপন করতে। সে সঙ্গে তোমাদের এত দিনের সব প্রাপ্তি, সফলতা, কিছু ব্যর্থতা, তোমাদের সাহস, দ্বন্দ্ব, আবেগ—সবকিছুই আজ আমরা উদ্যাপন করব। কারণ, তারুণ্যের এক নতুন জগতে তোমরা আজ প্রবেশ করতে চলেছ।
অনন্ত সম্ভাবনার দুয়ারে তোমরা এখন দাঁড়িয়ে আছ। বিজ্ঞান, কলা অথবা মানবিক—যে ক্ষেত্রেই তোমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক না কেন; তোমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা। মানুষের কল্যাণে কাজ করা, তাদের কষ্ট লাঘব করা, তাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা, আনন্দ দেওয়া—এ কাজগুলোকেই তোমাদের অনুপ্রেরণা করে নেওয়া উচিত। তোমাদের এই নব উত্থান আমাকেও উদ্বেলিত করছে। উইলিয়াম ব্লেক তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘আমার আঙুল থেকে স্ফুলিঙ্গ ঝরছে, ভবিষ্যৎ পরিশ্রমের প্রত্যাশায়’। এই ভাব আজকে আমার প্রাণেও দোলা দিচ্ছে।
আমরা বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত একটি পৃথিবীতে বাস করছি। কিন্তু তোমাদের কাঁধে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ প্রত্যাশার অনেক চাপ। তোমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। হৃদয়ের গভীর থেকে তোমাদের চাইতে হবে, যাতে মানুষ শান্তিতে, সমতায়, ন্যায়ে বেঁচে থাকতে পারে। তোমাদের স্বপ্ন হতে হবে এমন, যাতে গোটা পৃথিবী তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। যে সময়ে আমরা বাস করছি, সেটি খুবই জটিল ও বিভ্রান্তিকর। অর্থময় কোনো সংস্কৃতি আমাদের পথ দেখাচ্ছে না; মিডিয়া, ফ্যাশন, বিনোদনের নামে আমাদের ওপর চলছে আগ্রাসন। অন্তঃসারশূন্য করপোরেট শক্তি আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। আমি তোমাদের বলব একে প্রত্যাখ্যান করতে। স্রোতে গা-ভাসিয়ে তোমরা জীবনটা পার করে দিও না। নিজেই নিজের সাফল্যের সংজ্ঞা তৈরি করো, অন্য কারও মাপকাঠিতে নিজেকে বিচার করো না। অন্য কারও প্রত্যাশার চাপ কিংবা ব্যর্থতাকে নিজের নিয়তি বানিয়ে নিও না।
তোমরা পৃথিবীর আশাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করো। তোমাদের মধ্যে সবকিছুই আছে, যেটা তোমাদের অমর করে তুলতে পারে। তোমাদের কল্পনাশক্তির প্রখরতা, স্বপ্নের তীব্র গতি, ভাষার নিষ্কলুষতা এবং তারুণ্য—এসব কিছু হারিয়ে যেতে দিও না। যদি কখনো অনুভব করো যে তুমি নিজের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছ, নিজের সব শুদ্ধসত্তা দিয়ে আবার বুঝতে শিখ, তুমি কে ছিলে? মনের গভীরে তুমি আসলে কে?
যদি তোমরা আমার কাছে জানতে চাও, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কোনটি? আমি বলব, সেটি হলো বর্তমানে বাস করা, এর প্রতিটি ক্ষণ উপভোগ করা। আমার সত্তার সবটুকু দিয়ে আমি তোমাদের অনুপ্রাণিত করতে চাই, বর্তমানকে দেখ, এই মুহূর্তে তোমার সামনে যে সময় বয়ে যাচ্ছে তাকে অনুভব করো। কারণ, শেষ পর্যন্ত তোমার জীবন বর্তমান কিছু মুহূর্তের সমষ্টি। অতীতের কোনো কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে কিংবা ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে একে তোমরা নষ্ট করো না। জীবন থেকে কখনো অনুপস্থিত থেকো না।
তোমরা বুঝতে পারবে, জীবনটা আসলে আমাদের ইচ্ছা কিংবা চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। জীবনে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু জিনিসই আসলে আমাদের বড় কিছু করতে সাহস জোগায়। তোমাদের সন্তানের হাসি, মায়ের কণ্ঠস্বর, প্রিয় ফলের মিষ্টি ঘ্রাণ, শীতের বিকেলে জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়া বাঁকা রোদ—এ রকম সাধারণ জিনিসই আমাদের জীবনের বড় বড় অনুপ্রেরণা দেয়। এসব ছোট জিনিসকে এড়িয়ে যেও না। এগুলো অনুভব করতে তোমার জীবনের গতিকে মাঝেমধ্যে একটু ধীর করো। নিজেকে প্রশ্ন করো, জীবনে তুমি কি চাও, শান্তি না স্বাচ্ছন্দ্য? তিব্বতের বুদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘কোনটি আগে আসবে, আগামীকাল বা আগামী জীবন? আমরা কখনো সেটা বলতে পারি না’। তাই আমি তোমাদের বলব, কখনো এটা মনে করো না যে জীবন সামনে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সব সময় পরের জিনিসটার জন্য বসে থেকো না। ভবিষ্যতের কোনো আইডিয়াতে নিজের সব সামর্থ্য ঢেলে দিয়ে নিঃস্ব হইও না। বর্তমান তোমার জন্য সম্ভাবনার অসংখ্য দ্বার খুলে অপেক্ষা করে আছে। জীবনকে একটা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নাও, পরিবর্তনের পথিক হও।
কখনো কখনো তোমাকে জীবনের মহৎ অ্যাডভেঞ্চারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সেটা করার সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে আজ, এখন। কারণ, তোমাদের এখন আছে তারুণ্য এবং অদম্য কৌতূহল। তথাকথিত সাফল্যের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রেখ না। জীবন সঠিক পথে চললে সাফল্য তোমার হাতে অবশ্যই ধরা দেবে। মনে রেখো সাফল্য বেশির ভাগ সময়ই কেবল ব্যক্তিগত একটি ঘটনা, কখনো কখনো তা আকস্মিকও বটে।
আজকে তোমরা তোমাদের পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চারে নেমে পড়ছ। কোনো কিছু শুরু করার সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো এর অনিশ্চয়তা। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো কীভাবে তুমি সেই অনিশ্চয়তাকে মেনে নাও এবং এর সম্মুখীন হও। পৃথিবী তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, একে ভ্রমণের মাধ্যমে তুমি নিজেকে আবিষ্কার করো। নিজেই নিজের পথপ্রদর্শক হও। কারও দ্বারা কোনো কাজে হতোদ্যম হইও না। যদি প্রয়োজন হয়, সোজা পথে না চলে পাশের সরু গলিপথ দিয়েও তুমি ভ্রমণ করতে পার। কিন্তু তোমার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত পথচলার আনন্দটা খুঁজে পাওয়া।
আমি প্রার্থনা করি, যাতে তোমরা শান্তির খোঁজ পাও। তোমরা মানবিক, সহানুভূতিশীল এবং এই পৃথিবীর যোগ্য মানুষ হও। তোমাদের হৃদয়ে যাতে একজন পরিব্রাজকের সাহস থাকে এবং তোমরা বর্তমানের প্রতিটি ক্ষণকে উপভোগ করো। তোমাদের জন্য রইল শুভকামনা। ধন্যবাদ।

Read More »